logo
ads

ডাকসু — নারী প্রতিনিধিত্ব, স্বার্থ ও পরিচয়ের সংঘাত: ফলাফল বিশ্লেষণ

নিপুণ চন্দ্র: 

প্রকাশকাল: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৪:১৬ পি.এম
ডাকসু — নারী প্রতিনিধিত্ব, স্বার্থ ও পরিচয়ের সংঘাত: ফলাফল বিশ্লেষণ

বাম থেকে ডানে- ফাতেমা তাসনিম জুমা, উম্মে ছালমা, সানজিদা আহমেদ তন্বি, সাবিকুন নাহার তামান্না, আফসানা আক্তার, হেমা চাকমা ও উম্মা উসওয়াতুন রাফিয়া।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন বরাবরই বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে এক প্রতীকী এবং কার্যকর ইভেন্ট। এর ফলাফল শুধু বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতির ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং দেশের মূলধারার রাজনৈতিক রূপান্তর এবং ভবিষ্যৎ ক্ষমতার সমীকরণ বোঝার ক্ষেত্রেও এর বড় ভূমিকা থাকে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ডাকসুর নির্বাচনে যেসব রাজনৈতিক শক্তি আধিপত্য বিস্তার করেছে, তারা পরবর্তীকালে জাতীয় রাজনীতির ময়দানেও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিয়েছে।

২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচনও এর ব্যতিক্রম নয়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক অবস্থান নয়, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জাতীয় রাজনীতিরও একটি রোডম্যাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় এবং এর বহু নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মানবতার অপরাধের বিচার চলমান থাকায় জাতীয় রাজনীতির ময়দানে বিএনপি, জামায়াত এবং তাদের সহযোগী সংগঠনগুলিই বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই বাস্তবতায় ডাকসুর নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ব্যাপক সাফল্য, বামপন্থী জোটের কিছুটা সাফল্য এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের উত্থান নিঃসন্দেহে আগামী দিনের রাজনীতির জন্য তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করছে।

ভোটের চিত্র ও অংশগ্রহণ
সরকারি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধিত ভোটার সংখ্যা প্রায় ৩৯,৭৭৫। সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুসারে ভোট পড়েছে মোটামুটি ৭৮–৮০%, অর্থাৎ প্রায় ৩১,০০০–৩১,৮২০ ভোট। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ও টানটান উত্তেজনার মধ্যেও এত উচ্চমাত্রার ভোটার অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে ছাত্রসমাজ রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে আগ্রহী।

নির্বাচনী ফলাফল: কিছু উল্লেখযোগ্য সংখ্যা
মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক: ফাতেমা তাসনিম জুমা (ছাত্রশিবির) — ১০,৬৩১ ভোট (৩৪.৩%)।
কমন রুম, রিডিং রুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক: উম্মে ছালমা (ছাত্রশিবির) — ৯,৯২০ ভোট (৩২.০%)।
গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক: সানজিদা আহমেদ তন্বি (স্বতন্ত্র) — ১১,৭৭৮ ভোট (৩৮.০%)।
সদস্য: সাবিকুন নাহার তামান্না (ছাত্রশিবির) — ১০,০৮৪ ভোট (৩২.৫%)।
সদস্য: আফসানা আক্তার (ছাত্রশিবির) — ৫,৭৪৭ ভোট (১৮.৫%)।
সদস্য: হেমা চাকমা (বামপন্থী প্যানেল) — ৪,৯০৮ ভোট (১৫.৮%)।
সদস্য: উম্মা উসওয়াতুন রাফিয়া (স্বতন্ত্র) — ৪,২০৯ ভোট (১৩.৬%)।
এগুলো কেবল কয়েকটি পদ, তবে সামগ্রিকভাবে দেখা যায় শিবির-সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে।

নারী প্রতিনিধিত্ব: সংখ্যা ও প্রেক্ষাপট
মোট ২৮টি পদে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন ৭ জন নারী প্রার্থী, অর্থাৎ ২৫% নারী প্রতিনিধিত্ব। সংখ্যাগতভাবে এটি অনেকের কাছে ইতিবাচক শোনাতে পারে। কিন্তু গভীরে গেলে বাস্তবতা ভিন্ন।

মোট ৪৭১ জন প্রার্থীর মধ্যে নারী ছিলেন মাত্র ৬২ জন, অর্থাৎ প্রার্থীতার স্তরেই নারীদের অংশগ্রহণ ছিল খুব সীমিত (প্রায় ১৩%)। এ অবস্থায় ৭ জন নারীর জয় তাদের ব্যক্তিগত সক্ষমতা ও সংগঠনের সমর্থনের প্রতিফলন হলেও সামগ্রিকভাবে নারী ক্ষমতায়নের চিত্র আশাব্যঞ্জক নয়।

এর মধ্যে তিনজন নারীকে পূর্ণ হিজাবে দেখা গেছে—যা নিঃসন্দেহে ইসলামী সাংস্কৃতিক ধারার একটি প্রতীকী প্রকাশ। এতে বোঝা যায়, ধর্মীয় মূল্যবোধকেও উপেক্ষা না করে নারীরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নিজেদের জায়গা তৈরি করতে চাইছেন। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়: নারীরা কি কেবল নির্দিষ্ট রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ধারা মেনেই সামনে আসতে পারছেন, নাকি তাদের জন্য সত্যিকার অর্থে বহুমাত্রিক অংশগ্রহণের পরিবেশ তৈরি হয়েছে?

মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ ও ছাত্রশিবিরের সাফল্য
সবচেয়ে আলোচিত ফলাফল এসেছে “মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক” পদ থেকে। সেখানে বিজয়ী হয়েছেন ছাত্রশিবির সমর্থিত প্রার্থী ফাতেমা তাসনিম জুমা। এটি প্রতীকীভাবে বড় এক ঘটনা, কারণ ঐতিহাসিকভাবে জামায়াত ও শিবির মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি হিসেবে পরিচিত।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে—এ পদে দায়িত্ব পাওয়া একজন প্রার্থী কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে লালন করবেন? তিনি কি একে নতুন প্রজন্মের কাছে অর্থবহ করে তুলবেন, নাকি এ বিতর্ককে উপেক্ষা করে অন্য পথে হাঁটবেন? অনেকেই মনে করছেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অতিরিক্ত রাজনৈতিক চর্চা সাধারণ মানুষের কাছে বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে, এবং এর সুযোগেই শিবির এই পদে জয়লাভ করেছে।

উপজাতি ও সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব
এবারের নির্বাচনে দুটি উপজাতি প্রার্থী—যাদের একজন হেমা চাকমা—বিজয়ী হয়েছেন। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১% উপজাতি সম্প্রদায়ের জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি প্রতীকী জয়। তবে প্রতীকী সাফল্যের বাইরে গিয়ে টেকসই নীতি সহায়তা ছাড়া এ অর্জন স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারবে কি না, সেটি বড় প্রশ্ন।

অন্যদিকে, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭–৮% হিন্দু সম্প্রদায় থেকে এ নির্বাচনে কোনো প্রার্থী জয়ী হতে পারেননি। এটি অবশ্যই উদ্বেগজনক, কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিটি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত। হিন্দুদের অনুপস্থিতি সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও নিরাপত্তা নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলেছে।

হিজাব, সংস্কৃতি ও রাজনীতির নতুন বাস্তবতা
নারী বিজয়ীদের মধ্যে তিনজনকে পূর্ণ হিজাবে দেখা গেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি কেবল পোশাক নয়; এটি একটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বার্তা। ইসলামী ধারা এখন নারী নেতৃত্বেও প্রভাব বিস্তার করছে। এর ইতিবাচক দিক হলো, হিজাব পরিহিত নারীরাও রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন; তবে নেতিবাচক প্রশ্নও আছে—এটি কি নারীর বহুমাত্রিক মুক্ত অংশগ্রহণকে সংকুচিত করছে?

জাতীয় রাজনীতির প্রতিফলন
ডাকসুর নির্বাচন সবসময়ই জাতীয় রাজনীতির আয়না। এবারের ফলাফলেও সেটি পরিষ্কার:
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ থাকায় তাদের প্রভাব শূন্য।
বিএনপি ও জামায়াত রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে।
শিবির সরাসরি নেতৃত্বে এসেছে, যা জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতের অবস্থানকে শক্ত করবে।
বামপন্থী জোট কিছু আসন পেয়েছে, তবে তাদের প্রভাব সীমিত।
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জয় তরুণদের বিকল্পধারার প্রতি আকর্ষণের ইঙ্গিত দেয়।
এ থেকেই ধারণা করা হচ্ছে, জাতীয় রাজনীতিতে আগামী দিনে ইসলামী ধারার প্রভাব আরও জোরালো হবে, আর বামপন্থী ও স্বতন্ত্ররা প্রান্তিক চ্যালেঞ্জ হিসেবেই থেকে যাবে।

পরিশেষে দেখা গেছে, 
ডাকসু নির্বাচন ২০২৫ কেবল একটি ক্যাম্পাস নির্বাচন নয়; এটি বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যতের একটি নীলনকশা।
নারী প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে সংখ্যায় (২৫%), কিন্তু বাস্তবে এটি নারীর পূর্ণ ক্ষমতায়ন নয়।
মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে নতুন প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
উপজাতি প্রার্থীর জয় প্রতীকী সাফল্য হলেও দীর্ঘমেয়াদে টেকসই প্রতিনিধিত্ব এখনো অনিশ্চিত।
হিন্দু প্রার্থীর অনুপস্থিতি গণতান্ত্রিক তথা জাতিগত অন্তর্ভুক্তির জন্য নেতিবাচক বার্তা।
শিবিরের উত্থান জাতীয় রাজনীতির জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা — ইসলামী শক্তি মাঠে ফিরে আসছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ডাকসু নির্বাচন ২০২৫ হলো বাংলাদেশের আগামী রাজনৈতিক বাস্তবতার একটি ক্ষুদ্র প্রতিচ্ছবি। যদি এখানকার সমস্যাগুলো (নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন, সংখ্যালঘু নিরাপত্তা, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির সঠিক চর্চা) সমাধান না হয়, তবে জাতীয় রাজনীতিও একই ধরনের সংকটের মুখোমুখি হবে।

 

লেখক: নিপুণ চন্দ্র, মফস্বল সম্পাদক, দৈনিক বর্তমান বাংলা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর

হাইলাইটস

বিশেষ সংবাদ